হারিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম শহরের সিনেমা হলগুলো

0

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনঃ হারিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম শহরের সিনেমা হলো গুলো। প্রথমে রওশন টকিজ, তারপর রুপসী হয়ে রুপবানী। সর্বশেষ বন্ধ হলো কেয়া সিনেমা হল। নিবু নিবু অবস্থায় টিকে আছে একমাত্র মালঞ্চ সিনেমা হল। হয়ত সর্বশেষ টিকে থাকা এই হলটিও মাস দুয়েক পরে আর দেখা যাবে না। বন্ধ হয়ে যাবে এই হলটি। সে রকম আভাসই দিয়েছেন মালঞ্চ সিনেমা হলের বর্তমান মালিক জাহিদ মন্ডল। প্রতি মাসেই তাদের বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে কিন্তু একটু সুখের আশায় সিনেমার পেশা ধরে রেখেছেন। যদি আবারো সেই আশি নব্বই দশকের মতো দর্শক হয় তাহলে তারা সুখের আনন্দে ভেসে বেড়াবে। হয়ত সেই সময়ের মতো ভালো ভালো সিনেমা হয় কিংবা সরকার থেকে সিনেমা হলের জন্য অনুদান বরাদ্দ হয়। যা দিয়ে সিনেমা হলের পরিবেশ অত্যধুনিক করা হবে। জাহিদ মন্ডল ক্ষোপের সাথে বললেন “ যদি ইউটিউভ টা বন্ধ করে দেওয়া হয়! যদি উন্নত মানের ছবি তৈরী হয় তাহলে সিনেমার অবন্থা আবারো ফিরে আসবে। ”

তিনি আরো বলেন“ ভাই একটা রিক্সাওয়ালার ঘরে বিনোদনের মাধ্যম তার হাতে। মোবাইলে মাধ্যমে সে সিনেমা, গান ছাড়া ও অনেক কিছু দেখে থাকে, তাদের সময় কোথায় অযথা সিনেমা হল গুলোতে আসার?” ইউটিউভ ছাড়াও ডিসের প্রতিটি চ্যানেলে সিনেমা ছাড়াও বিনোদনের অনেক কিছু দেখানো হয় সমসময়। এছাড়া আগে খেলাধুলা দেখতে মানুষ মাঠে যেত, কিন্তু এখন ডিশের লাইন, ইউটিভব লাইনেই তারা ঘরে বসে আকর্শনীয় খেলা দেখে। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার কারনে দর্শকরা ভুলে গেছে সিনেমা হল গুলোতে সিনেমা দেখা। আগের যুগে সিনেমা দেখতে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়ে দাড়িঁয়ে থাকত কে আগে সিনেমা হলে প্রবেশ করবে। এ লাইন হতো টিকিট কাটতে এবং সিনেমা হলে প্রবেশ করতে। প্রচন্ড গরম কিংবা বৃষ্টিও বাঁধা হতে পারত না। হলের ভিতরে ভীড়ের কারনে অত্যাধিক গরমে শরীর থেকে ঘাম বের হলেও পিছু হটার কোন কারন নেই, দর্শকের চোখ আকটে আছে সিনেমার পর্দার দিকে। বিশেষ করে ঈদের দিনে সিনেমা দেখতে ঢল নামত প্রতিটি সিনেমা পাড়ায়। সিনেমার টিকিট কাটতে কিংবা হলে ঢুকতে লেগে যেত হুলস্থুল কান্ড। হলের ভিতরে তীল পরিমান জায়গা খালি থাকত না। টিকিট শেষ হয়ে যেত। দর্শকের চাহিদা পূরন করতে অনেকে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করে ব্যবসা করত। সে সময় হারিয়ে গেছে। এখন হলের ভিতর খাঁ খাঁ করে । হাতে গোনা কিছু দর্শক হয়, কোন কোন শোতে কোন দর্শকই হয় না। তখন সিনেমা বন্ধ থাকে। আগের দিনে প্রতিদিন ৫টি শো হতো । সকাল ১০.৩০ , ১.৩০, ৪.৩০, ৭.৩০ ও ১০.৩০। আগের দিনের মানুষ রাতের শো দেখে রাতে বাড়ী ফিরত। এখন সেই রাতের ১০.৩০ মিনিটের শো চলে না। মালঞ্চ সিনেমা হলে ৬ জন সিনেমা পাগল ভক্ত চাকরী করে। এর মধ্যে আজিজুর রহমান একজন। সে টিকিট মাষ্টার । ১৯৭২ সালে যখন শহরের প্যারাডাইস পাড়ায় বর্তমান আর্টিজেন্স অফিস পাশে টিনের গুদাম ঘরে মালঞ্চ সিনেমা হল তৈরী হয় তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। তখন থেকে আজ অবদী চাকরী করছেন। শুরুতে তিনি বেতন পেতেন ৫৫ টাকা। আর এখন ২০১৯ বেতন পান ৩৬০০ টাকা। দিঘুলিয়ার বাসিন্দা আজিজুর রহমানের ১টি ছেলে ও ১ মেয়ে। এই বেতনে তার চলে না, কিন্তু এই বয়সে তার এই বেতনে চলতে হয়। কারন ৮ম শ্রেনী পাশ করা আজিজুর অন্য পেশায় তার অভিজ্ঞতা নেই। তার ছেলে শফিকুল একটা ভিডিও দোকানে চাকরী করে। এভাবে কোন মতে চলছে। বাসাইল উপজেলার ময়থা গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমান মানিক। টাঙ্গাইল শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন আর ভিক্টোরিয়া রোডে(বর্তমান কিছুক্ষণ হোটেল) সুরুচি হোটেল চালাতেন। স্বাধীনতার পর রওশন সিনেমা হলের মালিক মোজাহারুল ইসলাম চৌধুরী লেবু যখন তার অধীনে মির্জাপুর অনামিকা সিনেমা হল ছেড়ে দিতে চাইলেন তখন তারা দুই ভাই মির্জাপুর হলটি দায়িত্ব নিয়ে নিলেন এবং নতুন করে নাম দিলেন মুক্তা সিনেমা হল। এবং বছর দুই ব্যবসা করার পর ১৯৭২ সালে টাঙ্গাইল প্যারাডাইস পাড়ায় গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে মালঞ্চ সিনেমা হল নামে ব্যবসা চালু করলেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৮ ই আগষ্ট তার ৪ ভাই (আতাউর রহমান মানিক, বজলুর রহমান হীরা, ফয়জুর রহমান মাখন ও লুৎফর রহমান সানা) শহরের মিয়া পাড়ায় ৩০ শতাংশ ধানী জমিতে বিশাল আকারের সিনেমা হল নির্মান করেন। যা ২০০৭ সাল পর্যন্ত তাদের অধীনে ছিল। কারন ২০০৭ সালের জুলাই মাসে আমেরিকা প্রবাসী জুয়েলের নিকট মালঞ্চ হলের মালিকানা বিক্রি করে দেন। সেই থেকে মালিক জুয়েলের নিকট থেকে আদি টাঙ্গাইলের স্যাটেলাইট(ডিশ) ব্যবসায়ী জাহিদ মন্ডল ভাড়া নিয়ে মালঞ্চ সিনেমা হল চালাচ্ছেন। মাসে মাসে তার বড় ধরনের লোকসান জেনেও চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে এই আশায় তিনি পথ চেয়ে আছেন। তবে টাঙ্গাইল শহরে প্রথম সিনেমার ব্যবসার সুত্রপাত করেন ময়মনসিংহ ছায়াবানী সিনেমা হলের মালিক নটুকর। প্রায় ১৯৬০ সালের দিকে শহরের পার্ক বাজারের পাশে আরফান খানের গুদাম ঘর ভাড়া নিয়ে কালি সিনেমা চালু করেন। বছর দুই চালানোর পর পরবর্তীতে শহরের বাসিন্দা আজাহার উদ্দিন চৌধুরী, সামাদ উকিল, রউফ মিয়া ও নাসির উদ্দিনের বাবার হাতে কালি সিনেমার ভার তুলে দেন এবং তারা চুটিয়ে ব্যবসায় এগিয়ে যেতে থাকেন। যদিও আজাহার উদ্দিন চৌধুরী ছাড়া বাকী অংশীদারগন ব্যবসায় মনোযোগ না দিলে আজাহার উদ্দিন চৌধুরী তাদের অংশীদারিত্ব কিনে নিয়ে নতুন করে লাইসেন্স করেন। আজাহার উদ্দিন চৌধুরী তৎকালীন এসডিও (নামটা জানা যায়নি) বরাবর প্রিটিশন করেন এবং সেই এসডিও আজাহার উদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে লাইসেন্স করে তাকে অনুরোধ করেন তার মৃত কন্যা রওশনের নামে সিনেমা হলটির নাম দেওয়া যায় কিনা ? আজাহার উদ্দিন চৌধুরী রওশন টকিজ নাম দিয়ে শহরের নিরালা মোড়ে করোনেশন নাট্য বিতানের(সিডিসি)হল রুম ভাড়া নিয়ে সিনেমা চালাতে থাকেন। পরবর্তীতে আজাহার উদ্দিনের ৩ ছেলে আজিজুর রহমান চৌধুরী খোকা, মোজাহারুল ইসলাম লেবু ও আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী আবু দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এর মধ্যে মেজ ছেলে মোজাহারুল ইসলাম লেবু একক প্রচেষ্টায় ধনবাড়ী উপজেলায় মধুসন্ধ্যা সিনেমা হল, মির্জাপুর উপজেলায় অনামিকা সিনেমা হল ও নাগরপুরে আরো একটি সিনেমা হল নির্মান করে ব্যবসায় করেন। যা স্বাধীনতার পর পর তার একক মালিকানাধীন সিনেমা হলগুলি বিক্রি করে দেন। ১৯৭৬ সালের শুরু দিকে রওশন টকিজের অংশীদারগন ৩ ভাই মিলে শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় ৩৬ শতাংশ জমিতে আরো একটি সিনেমা হল তৈরী করেন। দুই তলা বিশিষ্ট সুন্দর পাকা দালানের কারনে সুন্দর দেখা যেত। যা “রুপসী সিনেমা ” নাম করন করা হয়।

মোজাহারুল ইসলাম চৌধুরী লেবু ১৯৮৭ এবং ১৯৮৯ সালে একক ভাবে এলাসিনে আশা সিনেমা এবং পাথরাইলে চৌধুরী টকিজ নামে দুটি সিনেমা হল নির্মান করেন। যা পরবর্তীতে সিনেমা ব্যবসায় মন্দা কারনে বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ২০০৫ সালের দিকে রওশন টকিজও। করোনেশন নাট্য বিতান পরবর্তীতে সেখানে গড়ে তুলেন সিডিসি শপিং কমপ্লেক্স । যেখানে এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের পাশাপাশি বিভিন্ন দোকানের অবস্থান। ২০০৮ সালে রুপসী সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে সর্বশেষ রিয়াজ ও রিয়ার “ মনে পড়ে তোমাকে ” সিনেমাটি প্রদর্শন হয়। ডেভলপার প্রিমিও প্রোপাট্রির সাথে যৌথ মালিকানায় ১০ তলা বহুতল ভবন তৈরী করেন। যেখানে এখন আবাসিকের পাশাপাশি অফিস ও নিচু তলায় বিভিন্ন দোকানের অবস্থান। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে ১০ শতাংশ জমির উপর আফজাল চৌধুরী শহরের পুর্ব আদালত পাড়ায় তার স্ত্রী কেয়ার নামে তৈরী করেন কেয়া সিনেমা হল। আশি-নব্বই দশকে জমজমাট ব্যবসা হয়। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে সিনেমায় লোকসান হতে থাকলেও ঢাকার সিনেমার প্রযোজকদের সহযোগিতা কিছুদিন ব্যবসা চালিয়ে যান। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে তার ছেলে ফিরোজ চৌধুরী সিনেমা হল টি বন্ধ করে দেন। এখানে শপিংমল করার চিন্তা ভাবনা করছেন। ১৯৬৪ সালে প্যারাডাইস পাড়ার বাসিন্দা মন্টু চৌধুরী তার স্ত্রী আনোয়ারা চৌধুরীর উৎসাহে শহরের মেইন রোডে নির্মান করেন রুপবানী সিনেমা হল। ২০১৪ সালের দিকে সিনেমার বাজার মন্দার পাশাপাশি সিনেমা হলটির মালিকানা বিরোধে কারনে বন্ধ হয়ে যায়। রুপবাণী সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যাবার আরেকটি কারন বড় ধরনের বৈদ্যুতিক বিল বাকী পড়ে যাওয়া। সর্বশেষ মালঞ্চ সিনেমা হলটি বন্ধ হলে টাঙ্গাইল শহরে বিনোদনের জন্য কোন সিনেমা হল থাকবে না। যা পরবর্তীতে ভালো কোন সিনেমা তৈরী হলেও টাঙ্গাইলের দর্শকদের দেখার কোন উপায় নাই। তাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে টেলিভিশন পর্দা কিংবা ইন্টারনেটের ইউটিউভের দিকে।

সূত্রঃ দুলাল চৌধুরী,রওশন ও রুপসী সিনেমা হল, জাহিদ মন্ডল, মালঞ্চ সিনেমা হল, শ্যামল দত্ত, রুপবানী সিনেমা হল, ফিরোজ চৌধুরী, কেয়া সিনেমা হল ও মিজানুর রহমান দোলন, মালঞ্চ সিনেমা হল।
প্রতিবেদকঃ আরমান কবীর সৈকত

Leave A Reply

Your email address will not be published.