‘দেবী দুর্গা’- কৈলাস থেকে পিতৃ গৃহে

0

বিশেষ প্রতিবেদনঃ বাংলার কৃষি নির্ভর জীবন যাত্রার সাথে কবে কখন অরণ্যচারী জনদের ভাবনা এসে যুক্ত হলো তার কোন হিসেব পত্র নেই। গৃহচারী আর অরণ্যচারী দু’পক্ষই যে এককালে মাতৃপ্রধান সমাজকে গ্রহণ করেছিল এ কথা আজ স্বীকৃত। শিরোণামে ভৌগোলিক একটা ছোঁয়া দেয়ার কারণ হিসেবে প্রথমেই বাংলা অঞ্চলের উত্তর প্রান্তের প্রকৃতি, বসতি ও জীবনাচরণের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা খুবই প্রয়োজন। বাংলা অঞ্চলের উত্তরাংশ থেকে উত্তর প্রান্ত সীমা অর্থাৎ হিমালয়ের পাদদেশ জুড়ে শিলাস্তুপ ঘেরা অরণ্যে ছাওয়া বিশাল অঞ্চল। কৃষি কর্মের একেবারেই অনুপযোগী এ অঞ্চল, যার কারণে কোন কৃষি নির্ভর সমাজ এখানে গড়ে উঠেনি। পরিবার সর্বস্ব ভ্রাম্যমান শিকারী গোষ্ঠির বসবাস ছিল এ স্থানে, এ রকম বহু বিবরণ মেলে সমকালীন ভ্রমণকারী কিংবা জরিপ কর্ম সম্পাদনকারী নানাজনের চাক্ষুষ বিবরণ থেকে।
ইতিহাস পূর্ব কাল থেকে এ অঞ্চলে আদিবাসীগণ কৌম জীবন যাপন করতো। আদিবাসী এই কৌমই জন্ম দিয়েছে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং পরবর্তী কালে মাতৃদেবীর। কেমন ছিল এ অঞ্চলের আদিম কৌম গোষ্ঠির মাতৃকা দেবী? তবে সর্বজন বিদিত যে বিষয়টি তা হলো ‘বুড়ী’ পূজা। বুড়ী হিসেবে পূজিতা এই মাতৃদেবীর আবাসস্থল ছিল বনে জঙ্গলে কিংবা নির্জন কোন স্থানে, গ্রামের প্রবেশ পথে। এখনও বাংলার আনাচে কানাচে নানা অঞ্চলে বট পাকুড়ের ছায়ায় এই ‘বুড়ীর স্থান’ বিরাজমান। ‘বুড়ী মা’ বলে পরিচিতা এই মাতৃকা দেবীই আদি মাতা হিসেবে চিহ্নিত গবেষকগণের কাছে।
এবার আসা যাক উত্তরাঞ্চলের এই আদিম মাতৃদেবীর কৌম রূপ থেকে পৌরাণিক মাতৃদেবীর আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে। আদিম এরূপ থেকে পৌরাণিক রূপের পেছনে তন্ত্রাশ্রয়ী হিন্দু ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির হাওয়া যথেষ্ট অনুকুল ছিল। বিশেষ করে যাদুমন্ত্রের দেশ খ্যাত কামাখ্যা কামরূপ অঞ্চলকে আশ্রয় করে গড়ে উঠা তন্ত্র অর্থাৎ তন্ত্রাশ্রয়ী হিন্দু ধর্মের চূড়ান্ত বিকাশ কালে কামতেশ্বরী মাতৃকা দেবীর পূর্ণ রূপের প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে দেখা যায় হিন্দু ধর্মের নানা আচার অনুষ্ঠান আদিবাসী সমাজের ধ্যান ধারণাকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে। ব্রাহ্মণ সমাজ নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার কারণে বাধ্য হয়ে এসব অরণ্যচারী জনের আচার অনুষ্ঠান মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
দেবী চন্ডী আসলে কামতেশ্বরী এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছে গোসানী মঙ্গল নামে একটি প্রাচীন পুঁথি। কৌম সমাজে মাতৃকা দেবীর চন্ডীরূপের প্রতিষ্ঠা এর প্রধান আলোচ্য বিষয়। কামতেশ্বরী তথা চন্ডীর বরে রাজ্য লাভ, যশ লাভের প্রসঙ্গ দেখা যায় এ সব পুঁথিতে। শক্তির প্রকাশ যে এ উৎস থেকে উৎসারিত এটা অবশ্যই জোর দিয়ে বলা যায়। অতএব মাতৃকা দেবী কামতেশ্বরী চন্ডীতে রূপান্তরের পশ্চাতে সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়টি এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। কামতেশ্বরী তথা চন্ডী দেবীর পূজায় ব্রাহ্মণ পুরোহিত নিয়োগ ব্যাপারটি কামতেশ্বর নৃপতিগণের সময়ই শুরু হয়। প্রথম দিকে মৈথিল ব্রাহ্মণগণই পুরোহিত নিয়োজিত হতেন। মাতৃকা দেবীর এই রূপান্তরের পেছনে রাজনৈতিক বিষয়টি কাজ করেছে পুরো মাত্রায়। ব্রাহ্মণ প্রভাবের ফলশ্রুতিতে এ দেবী হিন্দু সমাজের আশ্রয় গ্রহণ করে এবং এর প্রভা ছড়িয়ে পড়ে সকল বর্ণ হিন্দু সমাজে।
আদিম জনগোষ্ঠি কোচ-সমাজের ইষ্টদেবী ভগবতী। ভগবতীই শেষাবধি মাতৃকা দেবীর পূর্ণাঙ্গ রূপ বলে প্রতীয়মান হয়। কালিকা পুরাণে মহামায়া, কামাখ্যা ও শারদা নামে পরিচিতা। শরৎকালে পূজিতা হন বলে তিনি শারদা। ভগবতী কামাখ্যারই নাম যে শারদা এ কথা পুরাণে উল্লেখ আছে। পূর্বে শরৎ কালে দেবগণ কর্তৃক মহাদেবী বোধিত হতেন এই নিমিত্ত পীঠ স্থানে এবং লোক মধ্যে তিনি শারদা নামে খ্যাত হন। উক্ত পুরাণে আরো উল্লেখ আছে যে, এই শারদা দেবী একাধারে কামাখ্যা দেবী, দুর্গা, নারায়ণী ও চন্ডী রূপিনী। মাতৃকা দেবীর যে শারদা রূপটির পূজা হয়ে থাকে শারদীয় দুর্গোৎসবের সময়, সে রূপটির আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য আছে। দেবীর গাত্র বর্ণ রক্তিম, তিনি দন্ডায়মানা, অসুর নিধনে উদ্যত। প্রতীক স্বরূপ মহিষাসুর রূপী অসুরের প্রতীক মহিষের মস্তক পাদদেশে স্থাপিত। সিংহ অসুরকে দংশন করছে, দেবীর শূল অসুর বক্ষে বিদ্ধ।
‘উমা’ নামটি নিয়ে গবেষকগণের নানা মত প্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ উমাকে বেবিলনীয় দেবী উম্মু এর সাথে তুলনা করতে চান। আসলে ‘উমা’ যে মাতৃ বা মা শব্দ থেকেই উৎপন্ন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেহেতু আমরা পূর্বে লক্ষ্য করেছি এর আদি রূপ মাতৃ প্রধান সমাজের মাতৃকা রূপ। শুধু চন্ডীতে রূপান্তরই নয় তিনি লোকায়ত নানা জনগোষ্ঠির নানা ভাবনায় কীর্তিত। কিরাত জনগোষ্ঠির মাঝে তিনি কিরাতীনি এবং অরণ্যচারী মানুষের কাছে তিনি পর্ণ শবরী রূপেও পূজিতা হতেন। ত্রিমুন্ড ধারী পর্ণ শবরীর পায়ের নীচেও দেখা যায় দলিত হচ্ছে পশুরূপী এক অসুর। দেবী বিন্দুবাসিনী নামেও পরিচিতা, জানা যায় বিন্দু পবর্ত বাসী বলে তিনি বিন্দুবাসিনী, অর্থাৎ দুর্গম পাবর্ত্য অঞ্চলে এই দেবী বাস করেন। দেবী বরাম চন্ডী রূপে পার্বতী নাগাসুরকে বধ করেন। মেদিনীপুর জেলায় মাঘ মাসে এই দেবী পূজিতা হন। কোথাও কোথাও তিনি বনদেবী রূপেও পূজিতা হন। ঢাকা মোমেনশাহী ও সিলেট অঞ্চলে বন দুর্গা নামে এক দেবীর উল্লেখ মেলে। লোকায়ত বাঙালি জীবনে শুভ দুর্গা, নব দুর্গা এসব দেবীর উল্লেখ মেলে, শুধু তাই নয় নানা ঋতুতে নানা রূপে এই দেবী ঘরে ঘরে পূজিতা হন বাঙালি সমাজে। যেমন- বৈশাখে গন্ধেশ্বরী পূজা। জৈষ্ঠ্য মাসে ফলহারিনী দেবীর পূজা। শ্রাবণে শাক সব্জির দেবী শাকম্বিরী’র পূজা। ভাদ্রে জীব-জগতের মিলন মাস দেবী পার্বতী নামে পূজিতা হয়। শরতের আশ্বিন মাসে জগৎধাত্রী রূপে বিশ্বেশ্বরী দেবী চতুরভুজা দুর্গা নবমীতে পূজিতা হয়। আবার শরৎকালে পূজিতা হন বলে তিনি শারদা। কার্তিক-অগ্রহায়ন মাসে কাত্তায়নী দেবী নামে অগ্রহায়নের পূর্বে পূজিতা হয়। পৌষ মাসে পৌষ কালী নামে দেবী পূজিতা হয়। উমা কৃষ্ণ মাঘ মাসে উমা রূপে আরাধনা করেন, রতনতি কালী নামে আসে মাঘ মাসে। রোগ জ্বালা মহামারীর মাস ফালগুন, শত নামে ডাকে দেবীকে ভক্তরা, দেবী সংকটনাশিনী নামে আসে এ মাসে। জীবন সংকট থেকে মুক্তি পাবার আশায় পূজিতা হয় দেবী সংকটনাশিনী। মা মহামায়ার আরাধনায় সুরৎ রাজার কাছ থেকে বসন্ত কালে দেবী বাসন্তী নামে পূজিতা হয়। ফলে রাজ্য ফিরে পায় সুরৎ রাজা। কৃষিনির্ভর কোমল প্রাণা আবেগ প্রবণ হিসেবে চিহ্নিত বাঙালি সমাজই তাকে গৃহের আঙিনায় আনতে বেশী প্রয়াসী এতে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। মাতৃ রূপে এবং শক্তি রূপিনী রূপেই শুধু নয়, বাঙালি দুর্গাকে কন্যা রূপেও দেখতে প্রয়াসী হয়েছেন। দুর্গা মাতৃরূপে যেমন হৃদয় আলোকিত করেছেন বাংলার ভক্ত কুলের কাছে, তেমনি বাঙালি পিতা মাতার কাছে দেবী উমা কন্যা রূপে কোল জুড়ে আছেন।
বাঙালির দুর্গা মন্দির যেন উমার পিতৃ মাতৃ গৃহ। একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হয়, পুরাণ সাক্ষ্য দেয়, কঠিন তপস্যা করে পর্বত রাজ হিমবান ও স্ত্রী মেনকা লাভ করেছিলেন একটি কন্যা সন্তান। তার নাম রেখেছিলেন পার্বতী। উপযুক্ত নাম, পর্বত রাজের কন্যা পার্বতী। পর্বত রাজের স্ত্রী মেনোকা কন্যা পার্বতী। নির্জন হিমালয় পর্বতের পার্বতী। মহামায়ার নবরূপ দেবী পার্বতী। জন্ম পরবর্তীতে রাজা হিমবান চমকে উঠলেন কন্যার রূপ দেখে, ত্রিলোচন সদৃশ্য, অষ্টভুজা এবং সর্ব শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে তেজ, পর্বত রাজের মাথা আপনি নুয়ে এলো, প্রনাম করলেন তিনি কন্যাকে। কন্যাই বললেন, ‘আমি মহেশ্বর আশ্রিতা বলে জেনো তোমরা সবাই।’ হিমবান ভয়ে কম্পমানে, পিতার এহেন অবস্থা দর্শনে দেবী তার তেজোময় রূপ পরিহার করে শান্ত কোমল রূপ ধারণ করলেন, সত্যিকারের একজন লাবণ্যময়ী, নম্র, কমল সদৃশ রূপে গৃহের সুশীল কন্যা রূপে নিজেকে জাহির করলেন। উমা রূপের এটাই আসল ঘটনা। মায়ার দেবী মহামায় দেবী দুর্গা ভিন্নরূপে দেবী কালীকা, দেবী চন্ডীকা, দেবী অম্বিকা রূপে প্রকাশিত হয় মহিষাসুর বধে। কখনো গৌরি, কখনো উমা, আবার কখনো তাপসী অর্পনা রূপে প্রকাশিত হয়েছেন ভক্ত জনের দৃষ্টিতে। ঠিক বাঙালি গৃহ বধুর মতো তিনি পুত্র কন্যা (কার্তিক, গণেশ ও লক্ষ্মী, সরস্বতী) সমভিব্যাহারে কৈলাস থেকে পিতৃ গৃহে আসেন। যেমন করে বাঙালি বধু তার সন্তানদের কোলে নিয়ে বেড়াতে আসেন পিতৃ গৃহে। চিরকালীন বাঙালি গৃহের মমতাময়ী কন্যা এই উমা। ভক্ত জনের দৃষ্টিতে বলা হয় ‘‘ভবের ভবানী, শীবের শিবানী, রুদ্রের রুদ্রানী, মহেশ্বর ঈশ্বরী; এক জম্মে সতি, পরজন্মে পার্বতী’’। তাই স্বামী মহেশ্বরকেও আমরা দেখি চালচিত্রের উপরি ভাগে তিনি সমাসীন, যেন পুরো পরিবারকে তিনি আগলে রাখছেন উর্ধলোক থেকে।
দুর্গা পূজার শুরুতে যে কুমারী পূজার আয়োজন করা হয় এর মাঝেই হয়তো নিহিত আছে দুর্গার কন্যারূপী রূপটির ধ্যান বা সাধনা। আরো গভীরে যেতে হলে ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীর নানা স্থানে অনুষ্ঠিত কুমারী কন্যার পুজোর দিকে ফিরে তাকাতে হয়। কুমারী সম্পর্কিত একটি দিক যেমন তন্ত্র সাধনার সঙ্গে যুক্ত অন্যদিকে নানা মারণ, উচাটন এসব আধি ভৌতিক ধারণার সাথেও সম্পর্কযুক্ত। তান্ত্রিক মতে নারী সাধনা বলে একটি বিষয় আছে, যা বামাচারী সাধকদের মধ্যে পালিত হয়। শিবকে তাই মাঝে মধ্যে বামাচারী তান্ত্রিকদের উপাস্য হিসেবে মেলাতে অসুবিধা হয় না। কুমারী তথা কৌমার্য বলতে আমরা সত্যিকার ভাবে কি বুঝাতে চাই, সে সম্পর্কে আমাদের নিজেদেরই ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। কুমারীত্ব তথা কৌমার্য এর প্রকৃত তাৎপর্য তরুণ তরুণী সমেত সমস্ত জগতের প্রাণ সৃষ্টির ক্ষমতাধারী এক সত্বা। আদতে এ দেবীর পরিকল্পনা অরণ্য পরিবেশে শিকার জীবনের অর্থনীতিতে। তারুণ্য তথা যৌবন রক্ষা, প্রজনন, গোষ্ঠির বৃদ্ধি কল্পে কন্যা তথা কুমারীর গুরুত্ব অপরিসীম। যামলতন্ত্রে এই কুমারী দেবী নানা নামে বিভূষিত সন্ধ্যা, সরস্বতী, কালিকা, সুভগা, উমা, মালিনী, ভৈরবী ইত্যাদি।
আদিম যুথবদ্ধ জীবন ব্যবস্থার প্রজনন শক্তির আধার নারী, দেবীর আসনে অধিষ্ঠিত হন ক্রমে নানা তান্ত্রিক মতের স্রোতোমুখে। বাঙালি জীবনাচরণে নারী মমতাময়ী মাতা, স্নেহময়ী কন্যা হিসেবে আদৃত। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো, পৃথিবীর নানা স্থানের দেব দেবীগণ যারাই কুমার বা কুমারী আখ্যা পেয়েছেন তারা সকলেই তরুণ তরুণী। চার সন্তানের জননী আমাদের দুর্গা দেবী ধ্যানে স্তবে কুমারী মুর্তিতে তরুণী। বাঙালি জীবনের কন্যা, গৃহের আলো, মঙ্গল দাত্রী হিসেবে পিতৃ মাতৃ কুলে আদৃতা। উমা সদৃশ এই কন্যার মুখ মন্ডলে যেন ছায়া পড়ে দেবী উমার। উমা তাই বাঙালি পিতৃ গৃহে তার স্থান করে নেন অতি সহজেই। বাঙালি তথা সমস্ত মানব সমাজের আত্ম চেতনার বিকাশ যেদিন থেকে ঘটতে শুরু করেছে সে সময় থেকেই পৌরাণিক বিষয় থেকে মুক্ত হয়ে মানবিক হয়ে উঠতে আকুল হয়েছে। এই আকুলতাই শেষাবধি দেবীর মানবায়নে সহায়তা করেছে এবং উমা হয়ে উঠেছে গৃহের কন্যা রূপী দেবী।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.