স্টাফ রিপোর্টার: এক যুগ আগে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদকে হত্যার ঘটনায় খান পরিবারের চার ভাইসহ ১০ জনকে খালাস দিয়েছে আদালত আর দুইজনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মাহমুদুল হাসান আজ রবিবার আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আসামিদের মধ্যে সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন। জানাযায়-অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক এ মেয়রকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।
মামলায় দন্ডপ্রাপ্তরা হলেন- কবির হোসেন ও মোহাম্মদ আলী। খান পরিবারের খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- আমানুর রহমান খান রানা, জাহিদুর রহমান খান কাঁকন, সহিদুর রহমান খান মুক্তি ও সানিয়াত খান বাপ্পা। এছাড়া অন্য আসামী মাসুদুর রহমান, ফরিদ হোসেন, নাসির উদ্দিন নুরু, আলমগীর হোসেন চাঁন, ছানোয়ার হোসেন ও দারোয়ান বাবু ওরফে দাঁত ভাঙা বাবু খালাস পেয়েছেন। এর বাইরে আনিসুল ইসলাম রাজা ও সমির মিয়া বিচার চলাকালে মারা যান।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরের কলেজ পাড়ায় আওয়ামী লীগের টাঙ্গাইল জেলা কমিটির সদস্য ফারুক আহমেদকে তার বাসার সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার তিনদিন পর ফারুকের স্ত্রী নাহার আহমেদ টাঙ্গাইল মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন।
পরে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তদন্তের দায়িত্ব পায়। ডিবি পুলিশ সন্দেহভাজন আনিসুল এবং মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। আদালতে দুজনের চাঞ্চল্যকর জবানবন্দিতে খান পরিবারের চার ভাইয়ের নাম উঠে আসে।
তবে পরে নাহার আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। সে জন্যই তাকে হত্যা করা হয় এবং টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই ওই হত্যাকান্ডে জড়িত বলে তিনি এমন টাই দাবি করেছিলেন।।
রানাদের চাচা শামসুর রহমান খান শাহজাহান আওয়ামী লীগের নেতা ও সংসদ সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ভাতিজারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন।
হত্যাকান্ডের তিন বছর বাদে ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। সেখানে আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিন ভাইসহ মোট ১৪ জনকে আসামি করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রার্থিতা থেকে সরে যেতে রাজি না হওয়ায় সাংসদ রানার সহযোগী কবির হোসেন পিস্তল দিয়ে ফারুক আহমদকে গুলি করেন। পরে সাংসদের নির্দেশে আনিছুল, মোহাম্মদ আলী, আবদুল হক, সমির ও কবির লাশ নিয়ে ফারুকের বাসার সামনে ফেলে রেখে আসেন।
২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর উপনির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাংসদ নির্বাচিত হন আমানুর রহমান খান রানা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
আমানুর রহমান খান রানা ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের চার ভাইকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় জেলা আওয়ামী লীগ।
২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। বিচার চলাকালে দুই আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা ও সমির মিয়া কারাগারে মারা যান। গত ২৬ জানুয়ারি ফারুক হত্যা মামলার যুক্তিতর্ক শেষে রোববার রায় ঘোষণা করা হলো।
প্রতিক্রিয়া: এ রায় ঘোষণার পর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের ছেলে আহমেদ মজিদ মোবাইলে জানান, মামলা দায়ের থেকে তদন্ত, আদালতে অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আসামিরা বিচার প্রক্রিয়ায় বিঘœ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, এই মামলার আসামিদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী নেতারা। তাঁরা ৫ আগস্টের পর আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এসব আইন কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এর আগের আইনজীবীরা আসামিদের ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।
বর্তমানে খান পরিবারের চারভাই কে কোথায়: রাজনৈতিক পেক্ষাপট পরিবর্তনের পর আমানুর রহমান খান রানা আত্মগোপনে যান। তার অপর দুইভাই ২০১৪ সাল থেকে বিদেশে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়। রানার আরেক ভাই সাবেক পৌর মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি অন্য একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
আমানুর রহমান খান রানার বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। সহিদুর রহমান খান মুক্তির বিরুদ্ধেও পাঁচটি হত্যাসহ অন্তত ৪০টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া জাহিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা এবং সানিয়াত খান বাপ্পার বিরুদ্ধে চারটি হত্যাসহ ডজন খানেক মামলা হয়েছে।
এত মামলা হলেও তাদের কখনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। কখনও তাদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হয়েছে। আবার কখনও আসামিদের চাপে বাদীপক্ষ মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ভয়ে কেউ কখনো আদালতে সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে যায়নি। এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় হত্যা, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা থাকলেও এর আগে কোনোটিরই রায় হয়নি। এই চার ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো যে মামলার রায় হলো, তাতে সকলেই খালাস পেলেন।