টাঙ্গাইল নতুন বাস টার্মিনাল থেকে বের হয়ে রাবনা বাই-পাসের আগে টাঙ্গাইল শহরের ময়লা ফেলার জায়গার কাছে দু’টি পলিথিনের ঝুঁপড়ি ঘর আছে । কেউ হয়তো কখনো নজরেই আনেনটি। আবার কেউ নজরে আনলেও তেমন গুরুত্ব দেননি। ঝুঁপড়ি ঘরের পাশেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ময়লার মাঝে এক পাল শুকরকে শুয়ে অলস সময় কাটাতে দেখা যায়। এই ঝুঁপড়ি ঘর দু’টির মালিক দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামের সাধন চন্দ্র দাস ও সিরাজগঞ্জ জেলার তারাশ উপজেলার শ্রী কৃষ্টপুর গ্রামের আদিবাসী শাঁওতাল রবি চন্দ্র দাস। দীর্ঘ তিন বছর ধরে তারা এখানে ৪০টি শুকর পালন করছে। না শুকর গুলো তাদের নয়।তার চাকুরি করে মাত্র। শুকর গুলোর দেখা শুনার দায়িত্ব তাদের।শুকরের মালিক ঢাকার ফার্মগেটের সজল রোজারিও। তিনি ফার্মগেটে শুকরের মাংশের দোকান পরিচালনা করেন। খুবই বিখ্যাত দোকান তার। এক নামে চেনে ফার্মগেট এলাকার লোকজন। টাঙ্গাইল ছাড়াও, গাজিপুর, নরসিংদি ও সিরাজগঞ্জে সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শুকর পালন করেন সজল রোজারিও।
সাধন ও রবি দাসের আদি পেশা ছিল বাঁশ বেতের কাজ। নিপুন হাতে তারা বাঁশ বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্পের কাজ করতেনে।বর্তমানে এই বেতের কাজে তাদের সংসার চালানো কস্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই বেছে নিতে হয়েছে শুকর পালনের কাজ। সাধন দাস মাসিক ৯ হাজার টাকা ও রবি দাস ৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ করে। এ ছাড়া দিনে দু’বার ৮০ টাকা করে খাওয়ার জন্য দেওয়া হয় তাদের।পরিবার পরিজন রেখে ময়লার ভাগাড়ে কাটছে তাদের জীবন। এখানেই খাওয়া-দাওয়া এখানেই ঘুমানো। সব কিছুই এখানে। শুধু মাত্র দূর্গা পুজোঁয় ৭ দিনের ছুটি পাওয়া যায়।
কেমন আছে তারা, বাড়ী ঘর ছেড়ে ময়লার ভাগাড়ে ভালো লাগে তাদের, তাদের সোজা উত্তর ভালো আছি। না খেয়ে কস্ট করার চেয়ে মাস শেষে যে বেতন পাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো আছি। পরিবার ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকি।
সাধন জানান, তার একটি মাত্র মেয়ে লক্ষী রানী দাস।দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী । পড়ায়-লেখায় বেশ ভালো। তার আশা, বড় হয়ে তার মেয়ে তাকে আর এই কাজ করতে দেবে না। এবার পুঁজোয় তার জন্য বেশ কিছু নতুন পোশাক কিনে রেখেছে তার জন্য।ছুটির কথা মনে হতেই চোখ চক চক করে উঠে তার। জানান, পুজোঁ ছাড়া বাড়ী যাওয়া হয়না তার। এক মাত্র মেয়ের কথা সব সময়ই মনে পড়ে । তার পরও তাদের জন্য এই ত্যাগ। বাঁশ বেতের কাজে আবার ফিরে যাবেন কিনা, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন না, সেটা দিয়ে পেট চলে না।
রবি চন্দ্র দাসের বড় পরিবার। ৪ ছেলে মেয়ে। দু’জনকে বিয়ে দিয়েছেন। আগে বাঁশ বেতের কাজ ছাড়াও কাঠের কাজ করতো। এখন শুকর পালন করে। বেশ সুখে আছেন তিনি।তিনি জানান কত দিন পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে থেকেছেন, তার হিসেব নেই। ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখা করাতে পারেননি শুধু মাত্র টাকার অভাবে। তার শুধু একটাই আফসোস কোন ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত নয়। তবে এখন যখন সুযোগ হয়েছে, নাতি পুতিকে শিক্ষিত দেখতে চান তিনি।
প্রতি মাসের ৩ তারিখে বেতন পান তারা। আজ ৩ তারিখ। তাদের সুপার ভাইজার সিরাজগঞ্জে বিরেন চন্দ্র দাস বিকাশে তাদের বেতন পাঠিয়েছে। মাঝে মাঝে তারা সেই টাকা নেড়ে চেড়ে দেখছে। নতুন টাকার ঘ্রান নিচ্ছেন তারা। এই ময়লার ভাগাড়েও একটি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে সেই টাকা।এই পুতি দূগর্ন্ধময় ময়লার মাঝে বসেও আমিও পেলাম সৎ ভাবে উপার্জিত সেই টাকার ঘ্রান। পাশের বড় রাস্তা দিয়ে উচ্চ স্বরে হর্ন বাঁজিয়ে টাঙ্গাইলের এক জন আলোচিত-সমালোচিত সাংসদ তার গাড়ীর বহর নিয়ে চলে গেলেন,তার পরেও অপার্থিব শান্তির একটা আবহ বিরাজ করছে, সাধন ও রবি দাসের পলিথিনের কুটিরে…..
সৎ ভাবে বেঁচে থাকার শান্তিই আলাদা……..সৎ ভাবে উপার্জিত টাকার ঘ্রানই অন্য রকম…
লেখকঃ আরমান কবীর সৈকত