নিউজ ডেস্কঃ আমার ওই একটাই বাবা। কলিজার টুকরা। তাকে হারিয়ে ফেললাম চিরদিনের জন্য। ওকে আর কখনও দেখতে পাব না। অনেক কষ্টে ছোট থেকে বড় করেছি। মানুষের মতো মানুষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হল না। আমার এতটুকু সোনামানিকটাকে খুনিরা কুপিয়ে কুপিয়ে মারতে পারল? ওরাও তো কোনো মায়ের সন্তান। তবে কেন ওরা আমার বুকের ধনটাকে কেড়ে নিল?’
এমন বুকফাটা আহাজারি মেধাবী কিশোর শুভ আহমেদের মা সুমি আক্তারের। সন্তান হারানোর শোকে শুক্রবার র্যাব কার্যালয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বরগুনা স্টাইলে টঙ্গীতে কিশোর গ্যাং পাপ্পু গ্রুপের হাতে শুভ খুন হয় গত ৭ জুলাই। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খুনিদের চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। গতকাল সাংবাদিকদের সামনে নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাসেম।
এ সময় র্যাব কর্মকর্তাদের চোখও ভিজে ওঠে। র্যাব কার্যালয়ে উপস্থিত শুভ আহমেদের পিতা মাতার বুকফাটা আহাজারিতে গুমোট হয়ে আসে বাতাস।
বাবা মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান ছিল শুভ। তাই তার মাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা ছিল না কারোই। শুভর বাবা রাজু আহমেদ স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে শুধু বলছিলেন, ‘ছেলেকে হারাইছ। এখন তুমিও কী মরতে চাও। তাইলে বিচার চাইবেটা কে? খুনিরা ধরা পড়েছে। তোমার ছেলে হত্যার বিচার হইব। একটু শান্ত হও।’
এ সময় আত্মীয় স্বজনরাও সাধ্যমতো চেষ্টা করছিলেন মাকে সান্ত্বনা দিতে।
স্ত্রীকে ডান হাতে জড়িয়ে ধরে রাজু আহমেদ নিজেও বারবার হাতের কবজিতে চোখ মুছছিলেন। কান্নাভেজা কণ্ঠে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া ছেলের স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন।
বলেন, আমাদের বিয়ে হয় ২০০৪ এর শেষের দিকে। দেড় বছর পরই মায়ের পেটে আসে শুভ। ওর জন্মসাল ২০০৬ এর ২২ নভেম্বর। সেই ছোট ছেলেটা আস্তে আস্তে বড় হল। লেখাপড়ায় খুবই ভালো ছিল। পাগার স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জেএসসি পরীক্ষায় প্রথম হয়।একদিন বলল, ‘আব্বু আমাকে আরও ভালো একটা স্কুলে দেন। ছেলে আবদার রাখতে গিয়ে বাড়ি থেকে দূরে হলেও ফিউচার ম্যাপ স্কুলে ভর্তি করলাম। এই স্কুলের সব শিক্ষক ছেলের সুনাম করত।’বাবা বলেন, ‘ছেলেটা আমার হিরের টুকরো ছিল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করত। কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব বলত। অতটুকুন ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ত। সেই ছোটবেলা থেকে আমার কাছেই ঘুমায়। বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমাতে পারত না। আমার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমাত। বলত বালিশে নাকি তার ঘুম হয় না। আমি বাচ্চাটাকে কোনো দিন একটা ধমকও দেয়নি। অথচ তাকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছে খুনিরা। রক্তমাখা লাশটা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছি। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে বড় কুমুল্লি গ্রামে আমাদের বাড়ির কবরস্থানে তাকে চিরদিনের জন্য দাফন করে এসেছি। আর সে কখনোই ঢাকা আসবে না।শুভর মা সুমি আক্তার বলেন, ৭ জুলাই রাত ৮টায় সেলুনে চুল কাটতে গেলাম বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় শুভ। রাত ১০টায় ফোন করে বলে, আমার আসতে একটু দেরি হবে। তোমরা খেয়ে নাও। এই শেষ কথা। ১১টা বাজে, ১২টা বাজে। ফোন বন্ধ। শুভর আব্বাকে বললাম, ছেলে বাসায় ফেরেনি ফোনও বন্ধ। রাত সাড়ে ১২টায় চার দিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। কিন্তু কোথাও ছেলের খোঁজ নেই। গভীর রাতে একজন খবর দেয়-মদিনা পাড়ায় রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে একটা লাশ পড়ে আছে। সেখানে গিয়ে ছেলের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়। এরপর থানা পুলিশ আসে। লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় ময়নাতদন্তের জন্য।শুভর পিতা রাজু আহমেদ বলেন, ‘গতরাতেই আমরা খবর পাই খুনিরা ধরা পড়েছে। র্যাব অফিস থেকে ফোন করে শুক্রবার সকালে আসতে বলে। সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হয়েছি। কিন্তু রাস্তা যেন আর শেষ হয় না। একদিকে জ্যাম, রাস্তা ভাঙা, তারপর বৃষ্টি। পারি না যে উইড়া উইড়া আইসা পড়ি। খুনিদের একবার দেখতে চাই। জিজ্ঞেস করুম, ক্যান মারলা আমার বাবাটাকে। ওর কী দোষ আছিল।’র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম সাংবাদিকদের বলেন, তুচ্ছ কারণে সুপরিকল্পিতভাবে শুভকে হত্যা করা হয়। খুনের নেতৃত্ব দেয় তারই সহপাঠী নবম শ্রেণির আরেক ছাত্র মৃদুল হাসান ওরফে পাপ্পু। ৬ মাস আগে নিহত শুভ ও পাপ্পুসহ ফিউচার ম্যাপ স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা সফরে ঢাকায় যায়। বাসে করে ফেরার পথে পাপ্পু তার এক বান্ধবীর সিটে বসলে বন্ধুবান্ধবরা হাসি তামাশা করে। এ সময় শুভ মোবাইল ফোনে ছবি তোলে। এতে ক্ষিপ্ত হয় পাপ্পু। বাসের মধ্যেই তাদের দু’জনের হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে অপমানের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাপ্পু। সে তার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সাব্বির, রাব্বু ও রনিকে নিয়ে শুভকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে খুনের পরিকল্পনা করে তারা। এজন্য একাধিক ধারালো ছুরি ও চাকু সংগ্রহ করা হয়।ঘটনার দিন শুভ সেলুন থেকে চুল কেটে বের হওয়ার সময় তাকে ডেকে নেয় পাপ্পু গ্রুপের সদস্যরা। এরপর নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে সুইস গিয়ার নামের ধারালো ছোরা দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। বুকে পিঠে ছুরির অসংখ্য আঘাতে গুরুতর আহত শুভ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে পালিয়ে বাঁচতে দেয়া হয়নি। দৌড়ে জাপটে ধরে আরেক দফা তাকে কোপানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে শুভ। চিরদিনের জন্য জীবন প্রদীপ নিভে যায় তার।র্যাব জানায়, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর টঙ্গী থানায় মামলা হলে রহস্য উদঘাটনে ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব। একপর্যায়ে বৃহস্পতিবার রাতে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত চার কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়।
এরা হল- গ্যাং লিডার মৃদুল হাসান ওরফে পাপ্পু ওরফে পাপ্পু খান, সাব্বির আহমেদ, রাব্বু হোসেন ওরফে রিয়াদ ও নূর মোহাম্মদ। এদের কেউই স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। সবাই নবম শ্রেণির ছাত্র। শুভ খুনের সঙ্গে জড়িত আরও বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছে র্যাব। এদের মধ্যে শাহদাত ওরফে কালা ওরফে রগকাটা কালা নামের এক যুবককে খোঁজা হচ্ছে।
র্যাব জানায়, টঙ্গী ও পার্শ্ববর্তী উত্তরা এলাকায় বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। পশ্চিমা কালচারের অনুকরণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় স্কুল কলেজ পড়ুয়া উঠতি বয়সীরা মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা ও প্রযুক্তি সহজলভ্যতার কারণে কিশোরদের একটা বড় অংশ অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। এর সঙ্গে অবধারিতভাবে আছে মাদকের ব্যবহার।
সংসাদ সুত্র- যুগান্তর অন লাইন. কম