নিউজ ডেস্কঃ নিজেদের আচিক ভাষায় গারোরা টাঙ্গাইলের মধুপুর বনকে বলেন ‘আবিমা’ বা ‘উর্বর মাটি’। টাঙ্গাইলের ঝরাপাতার শালবন মধুপুরে প্রথম বসতি স্থাপনকারী গারো জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা এখন এ ‘উর্বর মাটি’তে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। বনের ৬৫ শতাংশ মানুষই বাঙালি। কয়েক শ বছর ধরে বাস করলেও ৯৬ ভাগ গারোরই ভূসম্পত্তির কোনো দলিল নেই।
মধুপুরের ৪৪টি বনগ্রামে পরিচালিত এক জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে। বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) ২০১৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ জরিপ করে। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন সেড পরিচালক ফিলিপ গাইন। গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বনের আদি বাসিন্দা গারোদের আর্থসামাজিক অবস্থা, এখানকার জাতিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেসলাইন তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতেই এ জরিপ। গারোদের বিপন্নতার চিত্র উঠে এসেছে এ জরিপে। এর দিকে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’
এখন মধুপুর শালবন বলতে যে অঞ্চলটি বোঝায়, উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত। সেডের জরিপ হয় এসব ইউনিয়নের ৪৪ গ্রামের ১১ হাজার ৪৮টি পরিবারের ওপর।
৪৪টি গ্রামে বাঙালি ও গারো মিলিয়ে সংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৬১ শতাংশই বাঙালি। গারোদের সংখ্যা ৩৫ দশমিক ৩৯। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নের জনসংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৮০০। জনসংখ্যার প্রায় সবাই ছিল গারো, কিছু ছিল কোচ।
ব্রিটিশ আমলের আগে মধুপুরের বন টাঙ্গাইলের পন্নীদের মালিকানা ছিল। একপর্যায়ে নাটোরের মহারাজের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয় বনটি। ১৯৫০ সালে বনটি বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মধুপুরের চেহারা পাল্টাতে শুরু করে। অনুপ্রবেশ ঘটে বাঙালিদের।
ভূমির দখল ও মালিকানা মধুপুর বনের একটি জটিল বিষয়। জরিপে ভূমির মালিকানার চিত্রও উঠে এসেছে। মাত্র ৪ শতাংশ গারো পরিবারের এবং ১৩ শতাংশ বাঙালি পরিবারের এবং বসতবাড়ির সিএস অথবা আরওআর (স্বত্ব দলিল) আছে।
মধুপুরের ৪৪ গ্রামে বাঙালি ও গারো মিলিয়ে সংখ্যা ৪৭ হাজার ৭২৬। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৬১ শতাংশ বাঙালি। গারো আছে ৩৫ দশমিক ৩৯। ভূমির এই বিন্যাস একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে। তা হলো বনের গারোদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের বিষয়ে সরকার ও বন বিভাগের সঙ্গে একধরনের দ্বন্দ্ব আছে। সরকার ভূমির ওপর প্রথাগত অধিকার স্বীকার করে না। যদিও বনবাসী মানুষ চায় এ ধরনের মালিকানার আইনি স্বীকৃতি।
মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলছিলেন, ‘ভূমি নিয়ে আমরা এমন এক নাজুক অবস্থায় আছি, যেকোনো মুহূর্তে আমরা উদ্বাস্তু হয়ে যেতে পারি। যে ভূমিতে শত শত বছর ধরে আছি, তাতে আমাদের কোনো অধিকার নেই। আমরা প্রথাগত মালিকানার আইনি স্বীকৃতি চাই।’
বন বিভাগ মাঝেমধ্যেই বনবাসী মানুষদের উচ্ছেদ নোটিশ পাঠিয়ে ‘বনভূমি’ থেকে চলে যেতে বলে। বনবাসী মানুষ যদিও এটা উপেক্ষা করেই টিকে আছে।
বনবাসী মানুষকে এভাবে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় (এখনকার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়) একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে। গেজেটে বনের অরণখোলা মৌজার শালবনের ৯ হাজার ১৪৫ দশমিক ০৭ একর জমিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে। যেসব বনগ্রাম এই সংরক্ষিত বনের মধ্যে পড়েছে, সেগুলো মূলত গারো-অধ্যুষিত। এ ছাড়া কিছু কোচ ও বাঙালিও থাকে এসব গ্রামে।
মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় একটি সংখ্যায় কম জনগোষ্ঠী কী বিপর্যয়ের মুখে আছে, জরিপটি তারই প্রমাণ। নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রথাগত ভূমির অধিকারের বিষয়টি রাষ্ট্রকে আমলে নিতে হবে। এটা তাদের দায়িত্ব।’
মধুপুরের গারোদের এই সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি দরকার বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘গবেষণাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এটি আমাদের হাতে এলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।’