মোঃ মশিউর রহমান/টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধিঃ
আজ ২৫ নভেম্বর উত্থান একাদশী। তিথি অনুযায়ী এশিয়াখ্যাত এই দানবীরের ১২৪তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৯৬ সালের উত্থান একাদশীতে তিনি ঢাকার অদূরে সাভারের কাছুরে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার লৌহজং নদীর তীর ঘেঁষা মির্জাপুর গ্রামে।
মাতার নাম কুমুদিনী সাহা, পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ সাহা।
রণদা প্রসাদের জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে মির্জাপুর গ্রামবাসী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সকালে রণদার প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রার্থনা সভা, বিকেলে রণদা নাটমন্দিরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মাত্র সাত বছর বয়সে দরিদ্রতার জন্য টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় রণদা প্রসাদ মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুর পর দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করেন ভবিষ্যতে তিনি হতদরিদ্র চিকিৎসাবঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করবেন। মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ সাহা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দারিদ্র্যের কঠোর কশাঘাত ও সৎমায়ের অবহেলা ও অনাদারে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকেন রণদা। অভাবের তাড়নায় মানুষের বাড়িতে খাবার চেয়েও খেয়েছেন তিনি। জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য দিনমজুরের কাজ থেকে শুরু করে অনেক ধরনের কাজই তিনি করেছেন।
চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে যান রণদা। সেখানে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে মুটের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হন। এরই মধ্যে স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান করে কয়েকবার কারাবরণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক) যান। সেখানে তিনি হাসপাতালে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোগীদের জীবন বাঁচালে তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত (১৯১৬) বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন প্রদান করা হয়। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ সালে পঞ্চম জর্জের সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড সফর করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে রেলওয়ে বিভাগে টিকিট কালেক্টরের চাকরি নেন। পরে ১৯৩২ সালে চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি। উপার্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। এ সময়ে দ্য বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি নামে নৌপরিবহন সংস্থা এবং নৌপরিবহন বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪২-৪৩ সালে সরকারের খাদ্যশস্য ক্রয়ের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৪৪ সালে নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন এবং জর্জ এন্ডারসনের কাছ থেকে ‘জুট প্রেসিং বিজনেস’ এবং ‘গোডাউন ফর জুট স্টোরিং’ কিনে নেন। এরপর নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লায় ইংরেজদের মালিকানাধীন তিনটি পাওয়ার হাউস কেনেন। চামড়ার ব্যবসাও শুরু করেন এ সময়।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ এলাকা মির্জাপুরে ফিরে আসেন। সদা আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত আরপি সাহা ছেলেবেলার সংকল্পের কথা স্মরণ করে ১৯৩৮ সালে মির্জাপুর গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তী সময়ে ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট এবং বর্তমানে ১০৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ‘কুমুদিনী হাসপাতালে’ রূপ নেয়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে নিজে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হলেও নারীশিক্ষার জন্য তিনি ১৯৪২ সালে প্রপিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামে মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতেশ্বরী হোমস। তাছাড়াও টাঙ্গাইলে মায়ের নামে কুমুদিনী কলেজ, মানিকগঞ্জে বাবার নামে দেবেন্দ্রনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ মির্জাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। জীবনসংগ্রামে প্রতিষ্ঠা পেয়ে প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হলেও তিনি ভোগবিলাসে ব্যয় করেননি। তার জীবনের অর্জিত সব অর্থ তিনি উইল করে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল।
মহান এ ব্যক্তিকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ মে তার একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিসহ এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী অপহরণ করে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি।